কৈ মাছ

0
10

জুয়েল আশরাফ

বশীর ঘুমিয়েছে। মৃত্যু ঘুম। চোখ দুটি খোলা রয়েছে। খোলা চোখের মাছের মতোন। অবশ্য বশীরকে মাছেই মেরেছে। কৈ মাছ। একটা কৈ মাছ বশীরের পেটের নাড়িভুড়ি ছিড়ে লন্ডভন্ড করেছে তার জীবন। আজীবনের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ একজন বলল, চোখ দুটি বুজে দাও।
মৃত মানুষের চোখ বুজে দেওয়াই নিয়ম। পেটের ভেতরে কৈ মাছটা কি এখনও জীবিত? হাশমতের চিন্তা হচ্ছে অনেকক্ষণ। কৈ মাছের প্রাণ বলে কথা! এ সহজে মরে না। দাফনের সময় লাশ কবরে নামাতে গিয়ে দেখা যাবে পেটের ভেতর থেকে দুই একবার নড়েচড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এ জাতীয় ঘটনা নিছক নয়, ঘটতেই পারে। খুনের পেটের ভেতর খুনীর অস্তিত্ব জেনেই কী লাভ? মাছ তো আর বেঁচে ফিরতে পারবে না! বশীরের সঙ্গে মাছেরও দাফন হয়ে যাবে।
হাশমতের মন বলছে মাছকে খুনী বলে লাভ নেই। মাছেরই কী দোষ? বশীরের ভাগ্যেই লেখা ছিল কৈ মাছের কারণে মারা যাবে। ‘কৈ মাছের কারণে প্রাণ গেল যুবকের’- এই নিউজ কালকের কোনো দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হবে হাশমত জানে। কই মাছের কারণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা খুবই কম। লোকজন খুব কমই শুনেছে। এ জাতীয় ঘটনা পত্রিকায় এলে আগ্রহ নিয়ে পড়বে সবাই।
স্থানীয় সাংবাদিকরা এসেছে। ঘটনা লিখে নিচ্ছে, মন দিয়ে শুনছে কেউ, প্রশ্ন করছে কেউ কেউ। হাশমতকে জিজ্ঞেস করে কাগজে লিখে ফেলছে দ্রুত। অবশ্য হাশমত শুরু থেকেই প্রস্তুত হয়ে আছে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ শোনাবে। সে কাউকেই হতাশ করছে না। ‘কীভাবে মারা গেল’- যে কেউ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই হাশমত অধিক আগ্রহের সঙ্গে ঘটনা বলছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে বিস্তারিত বলতে। যেন একটি বিবরণও বাদ না পড়ে। লাশ দেখার চেয়ে হাশমতের মুখে ঘটনা শুনতেই লোকজনের ভেতর আগ্রহ বেশি দেখা গেল। এই ঘটনার সে-ই প্রথম এবং প্রধান স্বাক্ষী। এ জন্য তাকে ঘিরে একটি ছোট্ট ভিড় লেগে আছে।
সাংবাদিকদের ভিড় কমে গেছে। ঘটনা বিস্তারিত জানা গেছে। লাশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো কাদামাখা পায়ে লোকটি খুব আগ্রহের সঙ্গে মৃত্যুর কারণ বর্ণনা করেছে। এখনও করে যাচ্ছে। নতুন কেউ এলেই শোনার আগ্রহ নিয়ে তার কাছে যাচ্ছে, লোকটিও কাউকে নিরাশ করছে না। দুজনেরই পাশাপাশি বাড়ি। তিনি আর মৃত লোকটি আজ দুপুরে মাছ ধরতে বিলে গিয়েছিল। মৃত লোকটির নাম বশীর। কাদাপানি ঘেটে পলোর সাহায্যে কৈ শিং মাছের অস্তিত্ব খোঁজ করছিল তারা দুজন। বশীর একটি কৈ মাছ পেলো। রাখার মতো পাত্র না পেয়ে মুখের ভেতর মাছটিকে দুই দাঁতের মাঝে চেপে ধরল। হঠাৎ মাছটি এক ঝটকায় গলা দিয়ে নেমে চলে গেল পেটে। ভূমিকম্প আরম্ভ করে দিল পেটের ভেতর। যন্ত্রণায় বশীর প্রথমে জ্ঞান হারাল। এরপর হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়।
বাদ আছর জানাজা। মসজিদ মাইক থেকে এরকমই ঘোষণা হয়েছে।
হাশমতের কাজ শেষ। ঘটনা কয়েকশো লোককে বলা হয়ে গেছে। এখন একটি কাজ বাকি। জানাজায় যাওয়া লাগবে। হাশমত জানাজায় শরীক হওয়ার জন্য কবরস্থানের দিকে হাঁটছে। তার মাথায় তখনো সেই ভাবনা, কৈ মাছটি এখনও জীবিত আছে না নেই।

মাস খানিক পরের ঘটনা।
আষাঢ় মাস। সাত দিন ধরে টানা বৃষ্টি। প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। স্কুল মাঠ ভরে উঠেছে পানিতে। পাশেই পুকুর, পুকুরের মাছ খলবল করে স্রোতের সঙ্গে ভেসে এসেছে। বাড়ির আনাচে কানাচে গর্তের মতোন জায়গাতেও পানি। সেখানে মাছের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। মাছ-ধরার নেশায় গ্রামের লোকজন বৃষ্টি এবং বজ্রপাতকে তোয়াক্কা না করেই ঘর থেকে বেরিয়েছে। হাশমতের নয় বছরের মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে ভেজা মাটির বারান্দায়। তার গায়ে শীত পেয়ে থর থর করে কাঁপছে। কষ্ট হলেও তার খুব আনন্দ হচ্ছে। তাদের উঠানে। কৈ, শিং, মাগুর মাছ উঠে এসেছে। তার বাবা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তুলে নিচ্ছে। বাবার হাতে সিলভরের একটি ছোট্ট পাতিল। জাল অথবা বড়শি ছাড়াই খালি হাতে কই মাছগুলো তুলে পাতিলে রাখছে- দৃশ্যটি খুব উপভোগ করছে রোজিনা। মনে মনে সে এই দৃশ্যের নাম রেখেছে বৃষ্টি-কৈ।
রোজিনা আনন্দ উত্তেজনায় বলল, বাবা আমারে চারটা কৈ মাছ দিবা। আমি পানিতে রাখুম।
কাঁচের বোতলের একটি ছোট্ট একুরিয়ামের মতোন আছে রোজিনার। সেখানে সে মাছ জিইয়ে রাখতে ভালোবাসে। কিন্তু তার বাবা যখন সব মাছ নিয়ে ঘরে ফিরল, মা তাকে একটি মাছও ছুঁতে দিল না। শিং আর মাগুরের সঙ্গে কৈ মাছগুলোও কেটে দুপুরে রান্না হয়ে গেল। রাগ করে সে একটি মাছও খেল না, সব বাবার পাতে তুলে দিল। হাশমতের কৈ মাছ খুবই পছন্দ। নতুন পানির মাছ। খেতে সুস্বাদু। সে সব কয়টি কৈ একাই খেলো। কিন্তু খাওয়ার আধ ঘন্টা পরই হড়বড় করে বমি। সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণায় পেটে ব্যথা। তীব্র ব্যথায় হাশমত জ্ঞান হারাল। হাসপাতালে নেওয়ার পর জ্ঞান ফিরল ঠিকই কিন্তু ব্যথা কমল না। সব দেখেশুনে ডাক্তার জানাল ভয়ের কোনো কারণ নেই। ফুড পয়েজনিং। ব্যথানাশক কিছু ওষুধ দিলেন। বাড়িতে আনা হলো হাশমতকে। ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমেনি। হাশমত বুঝে গেছে, পেটের ভেতরে মাছের মতোন কী একটা জিনিস নড়েচড়ে উঠে নাড়িভুঁড়িতে যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে। পাপ করেছে সে। একটা ভয়ঙ্কর পাপ হয়ে গেছে। শুধু সম্পত্তির লোভে কী করুণ কৌশলে বশীরের পেটে কৈ মাছ ঢুকিয়ে দিয়েছে সে, এ কথা কোনোদিন কাউকে বলেনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here