Saturday, May 24, 2025
Homeগদ্যবিশ্বসাহিত্যে প্রেমের ভাষা

বিশ্বসাহিত্যে প্রেমের ভাষা

পল্লব শাহরিয়ার


প্রেম কেবল হৃদয়ের বিষয় নয়। কখনো তা মাটি ছোঁয়া বাস্তব, কখনো তা আকাশমগ্ন কল্পনা। প্রেম কেবল ভালোবাসা নয়, কখনো তা প্রতীক্ষা, কখনো তা শূন্যতা, আবার কখনো তা এক অব্যক্ত প্রতিজ্ঞা। বিশ্বসাহিত্যে প্রেম এক একটি রূপ পরিধান করেছে—যেমনটি গার্সিয়া মার্কেসের হাতে তা হয়ে উঠেছে প্রতীক্ষার প্রতিমা, টলস্টয়ের হাতে তা সমাজের সঙ্গে সংঘর্ষ, কুন্দেরার কাছে প্রেম হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মার এক বিপর্যস্ত নিরীক্ষা, আর কবাফিসের কবিতায় প্রেম কখনো এক চুম্বনের মতো নরম, আবার কখনো বেদনাবিধুর বিদায়ের মতো নীরব।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের Love in the Time of Cholera—এ প্রেম যেন সময়ের বিরুদ্ধাচার। এক অনন্ত প্রতীক্ষা, যেখানে সময় পেরিয়ে যায়, শহর বদলে যায়, রোগ আসে, মৃত্যু হয়, কিন্তু ভালোবাসা এক জেদি নদীর মতো বহমান থাকে। মার্কেসের কলমে প্রেম হলো ধৈর্যের পরীক্ষা, প্রেম হলো জীবনের শেষ বন্দর, যেখানে পৌঁছাতে সময় লাগে একটি জীবনকাল।
টলস্টয়ের হাতে প্রেম নিছক আবেগ নয়, বরং সমাজের কাঠামোতে আটকে থাকা মানুষের আত্মসংঘাত। Anna Karenina উপন্যাসে প্রেম শুধু কোনো ব্যক্তির কাছে পৌঁছানোর আকুতি নয়, বরং সমাজের রীতি, নিয়ম আর মূল্যবোধের সঙ্গে এক অসংগত সংগ্রাম। আন্নার প্রেম উন্মাদনা, অবাধ্যতা, আবার শেষমেশ আত্মধ্বংস। প্রেম এখানে মুক্তি নয়—একটা প্রশ্ন, যেটার উত্তর হয়তো সমাজ জানে না, কিংবা জানলেও মানে না।
মিলান কুন্দেরার লেখায় প্রেম কখনোই শুধুই সম্পর্ক নয়, বরং একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা—যেখানে ‘body’ ও ‘soul’–এর মধ্যকার দূরত্ব, অস্তিত্বের হালকা ও ভারী দিক, সবকিছুর সঙ্গে প্রেমের সংঘর্ষ ঘটে। The Unbearable Lightness of Being–এ প্রেম যেন জীবনদর্শনের এক পরীক্ষা। কোথাও তা কামনার রূপ নেয়, আবার কোথাও আত্মার নিঃসঙ্গ দহন।
কবাফিস—যার কবিতায় প্রেম একটি ক্ষণিক স্পর্শ, একটি অন্ধকার রাতে হঠাৎ জেগে ওঠা আলোর রেখা। তার কবিতায় প্রেম নিঃশব্দ, তবুও মুখর; শরীরী, তবুও অতিরোহী। যেখানে স্মৃতি হয়ে ওঠে প্রেমের মূল আধার—ভবিষ্যতের নয়, অতীতের প্রেম। তার এক একটি কবিতা যেন প্রমাণ করে, যে ভালোবাসা ছিল, হারিয়ে গেছে, তবু রয়ে গেছে তার গন্ধ—হৃদয়ের গভীরে, শরীরের অন্দরে।
এভাবেই বিশ্বসাহিত্যে প্রেম কখনো করুণ, কখনো নিষ্ঠুর, কখনো মহিমান্বিত। কিন্তু সবখানেই তা জীবনের মূল তন্তুর সঙ্গে জড়িত। কেউ প্রেমে জীবনকে বোঝে, কেউ প্রেমে নিজেকে, কেউ প্রেমে পুরো পৃথিবীকে।

২.
প্রেম চলে যায়, কিন্তু থেকে যায় তার ছায়া। স্মৃতির গহ্বরে জমে থাকে তার চলাফেরা, তার নিঃশ্বাস। কেউ কেউ বলে, হারানো প্রেমই সবচেয়ে দীর্ঘজীবী—কারণ বাস্তব প্রেম এক সময় ক্লান্ত হয়, কিন্তু স্মৃতির প্রেম কখনো মরে না।
হোর্হে লুইস বোর্হেস একবার বলেছিলেন, “We lose only what we never had.”—এই কথার মধ্যে প্রেমের স্মৃতি ও শূন্যতার মিলন ঘটে। যে প্রেম হয়তো কখনো পুরোপুরি মুঠোবন্দী হয়নি, তবু থেকে গেছে মনের ভিতরে। এই ভাবনারই ছায়া মেলে গার্সিয়া মার্কেসের গল্পেও, যেখানে সময় পেরিয়ে গেলেও প্রেম থেকে যায় এক অদৃশ্য নদীর মতো।
কুন্দেরার ভাষায় প্রেম শুধু একে অপরকে পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং একে অপরকে হারানোর মধ্যেও প্রেমের গভীরতা লুকিয়ে থাকে। তার চরিত্ররা প্রিয়জনকে হারানোর পরই আবিষ্কার করে তার প্রেম কতটা ছিল; ঠিক যেন কেউ বোঝে, হাওয়াকে কতটা প্রয়োজন, যখন তা হঠাৎ থেমে যায়।
জুলাইস বার্নেস-এর The Sense of an Ending–এ স্মৃতির প্রেম যেন এক সুদীর্ঘ অ্যালিগরি। প্রেম কী ছিল, কী হতে পারত—এই অনিশ্চয়তা নিয়েই চরিত্রেরা বাঁচে। স্মৃতি তাদের কাছে নরম নয়, বরং এক বিষণ্ন দংশন—যার আঘাতে আত্মা রক্তাক্ত হয়।
হ্যামসান বা কাফকার গল্পেও প্রেমের উপস্থিতি আছে—তবে তা কখনোই পূর্ণ নয়। কাফকার চিঠিতে ফেলিস বা মিলেনার প্রতি আকাঙ্ক্ষা গভীর, অথচ আত্মপ্রকাশে কুণ্ঠিত। কাফকার প্রেম চুপচাপ হাহাকার—কথা বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারে না। তার প্রেমিকেরা জানে, তারা ভালোবাসে, কিন্তু কেমনভাবে তা প্রকাশ করবে, তা জানে না। এই জড়তা, এই শূন্যতা, এই থেমে থাকা—সব মিলেই প্রেমের আরেকটি রূপ।
কবাফিস ফিরে আসেন বারবার। তার কবিতায় ‘সেই যে একদিন এসেছিলো’, ‘সেই মুখ’, ‘সেই ছোঁয়া’—সব কিছু রয়ে গেছে, হারিয়ে যাওয়ার পরও। যেমন এক কবিতায় তিনি বলেন, “And if you can’t shape your life the way you want, at least try as much as you can not to degrade it…”—এই চেষ্টাই যেন স্মৃতির প্রেম, যা হয়তো বর্তমানের কাছে হেরে যায়, কিন্তু হৃদয়ের ভিতর এক নীরব আলো জ্বেলে রাখে।
এইসব প্রেমের গল্পে প্রাপ্তি নেই, কিন্তু অনুভব আছে। সুখ নেই, কিন্তু গভীরতা আছে। এই প্রেমে ভালোবাসা শরীর ছুঁয়েছে না ছুঁয়েছে, তার চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে—ভালোবাসা কতটা হৃদয়ের আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছে।
এটাই সেই প্রেম, যা অনুপস্থিত, অথচ সবচেয়ে বেশি উপস্থিত। যে প্রেম আজ নেই, তবু প্রতিটি লেখায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি অশ্রুজলে রয়ে গেছে।

৩.
প্রেম যদি শুধু হৃদয়ের ব্যাপার হতো, তাহলে তা এত সহস্র গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতো না। প্রেম আসলে সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক নির্লজ্জ অনুভব—যা সমাজের তৈরি করা নিয়ম ভেঙে দেয়, যা ইতিহাসের কণ্ঠরোধ করা গল্পের দরজা খুলে দেয়। টলস্টয়ের ‘আন্না কারেনিনা’ এই সত্যকেই বড় করে তোলে। আন্নার প্রেম সামাজিক শৃঙ্খলার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে ওঠে। তার ট্র্যাজেডি শুধু এক নারীর পতন নয়, বরং এক ভালোবাসার অপূর্ণতা, যা সমাজ স্বীকার করতে পারেনি।
ঠিক তেমনভাবেই মিলান কুন্দেরা প্রেমকে দেখেন রাজনীতি ও চেতনার ছায়ায়। The Unbearable Lightness of Being–এ প্রেম একদিকে শারীরিক, অন্যদিকে রাজনৈতিক। প্রেম এখানে কেবল সম্পর্ক নয়, বরং অস্তিত্বের এক আলো-অন্ধকার খেলা। চরিত্ররা যেমন একে অপরকে খোঁজে, তেমনই খোঁজে নিজেদের ভেতরের আত্মপরিচয়—যা রাজনীতির ছায়ায় প্রতিনিয়ত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
কখনো প্রেম হয়ে ওঠে ইতিহাসের প্রতিবাদ। যেমনটি দেখা যায় আন্টোনিও লোবো আন্তুনেস-এর লেখায়। এক যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশে প্রেম মানে শুধুই স্নেহ নয়, একরকম প্রতিশ্রুতি—এই ধ্বংসাবশেষেও মানুষ ভালোবাসতে পারে, ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে পারে। প্রেম তখন আর কাব্যিক নয়, বরং এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যা মৃত্যুর মতো বাস্তব।
জেমস বাল্ডউইনের গল্পে প্রেমের আরেকটি রূপ—সংস্কারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী ঘোষণা। Giovanni’s Room এ প্রেম পুরুষের প্রতি, অথচ সমাজের চোখে তা নিষিদ্ধ। এই প্রেম লুকিয়ে থাকে, কিন্তু দগদগে হয়ে ওঠে আত্মার গভীরে। প্রেম এখানে একমাত্র সত্য, যা চরিত্রটিকে মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, আবার একই সাথে গভীর করে তোলে তার নিজস্বতা।
আর মুরাকামির গল্পে? সেখানে প্রেম প্রায় অতিলৌকিক। সময়, স্থান, বাস্তবতা—সবকিছুর গায়ে হাত বুলিয়ে সে তৈরি করে এক স্বপ্নের জগৎ। প্রেম কখনো সত্যি হয়, কখনো স্বপ্নের মতো হাতছানি হয়ে থাকে। কিন্তু সবক্ষেত্রেই প্রেম এক অন্তর্গত সংগীত—যা আমরা শুনি, তবু ছুঁতে পারি না।
এইসব লেখকের হাতে প্রেম হয়ে উঠেছে ভাষার বাইরের ভাষা। প্রেমকে তারা লিখেছেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ‘অনুভব’ করিয়েছেন। প্রেম যেন আর কেবল প্রেম নয়—তা হয়ে উঠেছে সময়, সমাজ, একাকিত্ব, আকাঙ্ক্ষা এবং অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি।
তাই আজ যখন আমরা প্রেমের কথা বলি, তখন শুধু ‘তোমায় ভালোবাসি’ বলি না। আমরা বলি—তোমাকে ভালোবাসি ইতিহাস ভুলে, সমাজ অস্বীকার করে, বাস্তবতা পেরিয়ে। ভালোবাসি যেমন ভালোবাসে একজন লেখক তার হারানো চরিত্রকে, যেমন ভালোবাসে পাঠক তার অসমাপ্ত গল্পকে।
এই ভালবাসা—নির্বাক, নিষিদ্ধ, নির্জন—তবু সবচেয়ে সত্য।
এই প্রেমই সাহিত্যের এক নীরব শিখা—যা নেভে না, শুধু বদলায়।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

জনপ্রিয়

Recent Comments

মোকাদ্দেস-এ-রাব্বী on আমার শুধু ঘুমিয়ে পড়া বাকি
মোকাদ্দেস-এ-রাব্বী on আকাশের কল্পনা
Sazzad Mohammad on বুবলি 
মোকাদ্দেস-এ-রাব্বী on বুবলি