Saturday, May 24, 2025
Homeগল্পবুবলি 

বুবলি 

লিখেছেন- সাজ্জাদ মোহাম্মদ

(এক)

বুবলি মেয়েটা কেমন?

পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি মত লম্বা। উজ্জ্বল শ্যামা। হরিনীর মত চোখ। ডিম্বাকৃতির মুখ। সবচেয়ে বড়কথা নায়িকা পপির ঠোটেের মত যার ঠোট – এমন মেয়েকে সুন্দরী না বলা নিতান্তই অন্যায় হবে। আমার ধারনা -পৃথিবীতে যে কজন শ্যামা সুন্দরী আছে বুলবুলি তাদের একজন। এমন একজন সুন্দরী মেয়ের নাম বুলবুলি রাখা হয়েছে কেন কে জানে! আমি নাম দিয়েছি-বুবলি।

বুলবুলির সাথে আমার প্রথম কথা হয় চাঁর বছর  আগে। কথা বলিয়েছিলেন নাজমুল হুদা। নাজমুল হুদা আমার বিশেষ পরিচিত একজন। কবি জাতীয় মানুষ। স্হানিয় পত্র পত্রিকায় কবিতা গল্প লিখেন।  কবিতা লেখার পাশাপাশি আলু পটলের দোকানও করেন। তার লেখা বেশির ভাগ কবিতা নাকি আলু পটলের দোকানে বসেই লেখা। এজন্য বেশির ভাগ লোকই তাকে পটল কবি বলেই চিনতো! ব্যাপারটা খুবই বেদনার। একটা কবিতা লিখতে একজন কবিকে কতটা ভাবতে হয় – মাথার চুল ছিঁড়তে হয়, যন্ত্রণা সইতে হয়, সেটা কেবল একজন কবিই জানে। অথচ, তরুণ একজন কবিকে এক শ্রেনীর মানুষ এমন ভাবে কটাক্ষ করেন কেন – কে জানে! আমি ডাকতাম – কবি হুদা।

সন্ধ্যের পর বাবু ভাইয়ের ঔষধের দোকানে বসে ছিলাম। কবি নাজমুল হুদা দোকানের সামনে এসে বললেন, ‘একটু বাইরে এসো- একজন তোমার সাথে কথা বলতে চায়।’ 

‘আপনি রুদ্র অধিকারী?’ 

‘হুম। আপনার নাম?’ 

‘নামটা জানা কি খুবই জরুরি?’

আমি কিছু বললাম না। কি বলবো বুঝতেও পারছিনা। মেয়েটা ভীষণ চটপটে। চটপট করে কথা বলা মেয়েদের সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলা আমার পক্ষ্যে একেবারেই অসম্ভব। 

কথা বললেন কবি নাজমুল হুদা। ‘ওর নাম -বুলবুলি। বেগম রোকেয়ায় পড়ে। তোমার একজন ভক্ত। তোমার সবগুলো ছড়া ওর মুখস্থ!’

আমি বুলবুলির দিকে তাকালাম। বুলবুলি বললো – ‘আপনি চমৎকার ছড়া লিখেন। অনেকদিনের ইচ্ছে আপনাকে কাছ থেকেই দেখার। ইচ্ছে পূরন হলো। আপনাকে একটা কথা বলতে পারি?’ 

‘পারেন।’ 

‘ছড়া লেখাটা বদ্ধ করবেননা প্লিজ। কারন, আমি আপনার ছড়ার প্রেমে পরে গেছি। গত একমাসে আপনার একটি ছড়াও পত্রিকায় আসেনি!’

বুলবুলি তার রিজার্ভ করা রিকশায় উঠতে উঠতে বললো – ‘আমাকে তুমি করে বলবেন। আপনি করে বললে লজ্জা লাগে। আর শুনুন,   একদিন আমাদের বাসায় আসবেন।’

আমি অপার বিস্ময় নিজের ভিতর চেপে রেখে বললাম -‘আচ্ছা।’

‘একদিন আমাদের বাসায় আসবেন’ এই কথাটা যে বুলবুলির কথার কথা ছিলনা- সেটা বুঝলাম তিনমাস পর, বুলবুলির চিঠি পেয়ে।  পোস্টাপিসের সরকারি খাম না, হাতে বানানো বেসরকারি খাম। খামের উপর ডাকটিকিট লাগিয়ে ডাক মাশুল পরিশোধ করা হয়েছে। ব্যাপারটা খারাপ না। ভালো। তবে, মোবাইল ইন্টানেটের যুগে চিঠি বড্ড বেমানান! বুলবুলি চিঠিতে যা লিখেছিলোঃ

Mr. রৌদ্র,

সেদিন আপনার সামনে দাড়িয়ে যতটা অবাক আপনাকে করতে চেয়েছিলাম- তার বিন্দু মাত্র অবাক আপনি হোননি। আমার ধারনা-আপনি অবাক হতে পারেন না। অথবা অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করতে পারেন না। রাইট?

জানি চিঠি পেয়েও অবাক হবেন না। অবাক হবেন ক্যামনে? আপনিতো টবাক জাতিয় মানুষ! বলুনতো টবাক মানে কী?

আমাদের বাসায় আসতে বলেছিলাম। আসেন নি। হাতির বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে আসা যায়, আমাদের বাসায় আসার সময় হয়না? That’s no matter. এতে কিছুই এসে যায়না আমার। শুধু আপনার উপর রেগে যাব আমি। আপনার গল্পটা পড়েছি। গল্পও দারুণ লিখতে পারেন। Many happy returns for “Shimu and Shako”

ইতি 

Miss বুলবুলি 

হনুমান তলা, রংপুর।

পূনশ্চঃ চিঠির উল্টোদিকে একটা মোবাইল নাম্নার দেয়া আছে। আপনি কি একবার ফোন করবেন? জাস্ট একবার।

তিনবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো – ‘হ্যালো।’ 

আমি বললাম-‘আসসালামু আলাইকুম।’ 

‘অলাইকুম সালাম। কে? ‘ 

‘রৌদ্র। রৌদ্র অধিকারী। ছড়াকার। আমি চমৎকার ছড়া লিখি! আপনি কি বুলবুলি?’ 

‘অন্য কেউ হবার সম্ভাবনা আছে? ‘ 

‘ফিফটি ফিফটি। ‘ 

‘ফিফটি ফিফটি কেন?’ 

‘যিনি আমাকে নাম্বারটা দিয়েছেন, তিনি বলেলনি এটা কার নাম্বার!’

‘কন্ঠ চিনতে পারছেন না?’

‘কন্ঠ চেনার ব্যাপার না, বোঝার ব্যাপার। আমি বুঝতে পারছিনা।’

‘ও।’

আমি ও প্রান্তে হতাশার গন্ধ পেলাম। তীব্র হতাশার গন্ধ! গন্ধ বেশিক্ষণ স্হায়ী হলোনা। ও প্রান্ত থেকে বলা হলো – ‘আমি বুলবুলি। চিঠি পেয়েছেন তাহলে?’ 

‘পেয়েছি।’ 

‘এই যুগে কেউ চিঠি লিখেনা! লিখে ?’ 

‘সরকারি চাকরি করা অনেক লোকই লেখে বোধয়।’ 

‘আমি সেই সরকারি চাকরি করাদের দলের নই।’ 

‘তা ঠিক।’ 

‘কেন ফোন করেছেন?’ 

‘একটা সমস্যায় পরেছি! তাছাড়া আপনিতো ফোন করতে বলেছিলেন। বলেননি?’ 

‘বলেছিলাম বোধয়। তো কি সমস্যায় পরলেন?’ 

‘শব্দ সমস্যা!’ 

‘মানে!’ 

‘মানে আপনি জানেন। বলুন-“টবাক” শব্দের মানে কি?’

বুলবুলি খিলখিল করে হেসে উঠলো। বললো-‘এর মানে ফোনে বলা যাবেনা। বলতে হবে মুখোমুখি। ফেইস টু ফেইস। আমাদের বাসায় আসুন – “টবাক” শব্দের মানে বলে দেব। হি হি! ‘

আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। মাথায় এখন নতুন পরিকল্পনা। কথা বললো বুলবুলি – ‘এটা আপনার নাম্বার?’ 

‘হু।’ 

‘কিন্তু, এই নাম্বারটাতো সবসময় বন্ধ থাকে।’ 

‘সবসময় থাকেনা। মাঝেমাঝে থাকে। কমদামী মোবাইল। ব্যাটারির লুজ কানেকশন সমস্যা আছে। আপনার মাথার মত! লুজ কানেকশন! 

‘কী?’ 

‘কিছুনা। রাখি।’ 

‘রৌদ্র…..’ 

‘শুনতে পাচ্ছি।’ 

‘একটা কথা বলতে পারি?’ 

‘পারেন। তবে, যা বলবেন তা শোনা নাও হতে পারে। মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে আসছে।’ 

‘একদিন বাসায় আসুন প্লিজ! কবে আসবেন?’ 

‘আসবো একদিন।’

মোবাইল বন্ধ হয়ে গেল।

রংপুর শহরের অদূরে হনুমান তলা। বিশাল এক বটগাছের গা ঘেঁষে হনুমানের একটা মূর্তি। একারনে জায়গার নাম “হনুমান তলা” কিনা কে জানে! হনুমান তলা থেকে একটু দূরে। জায়গার নাম-জলকর। জলকরে গিয়ে বুলবুলিদের বাড়ি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলোনা। ব্যাংকার আব্দুল হাদী সাহেবের নাম বলতেই সোজা বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলাম। সাদা ধবধবে তিনতলা বাড়িটাকে আমার কাছে তাজমহলের মতো মনে হলো। কিন্তু, এই বাড়ির নাম তাজমহল না। নাম হলো-“বুলবুলি কটেজ”।

আমি বুলবুলি কটেজের কলিং বেল টিপে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষার অবসান ঘটতে বেশি সময় লাগলোনা। প্রায় সাথে সাথেই বাড়ির ভিতর থেকে একজন ভদ্র মহিলা বেরিয়ে এলেন। দেখতে অবিকল অভিনেত্রী আনোয়ারার মতো। আমি বিনয়ের সাথে ভদ্র মহিলাকে সালাম দিলাম-‘আস্সালামু আলাইকুম।’ 

‘ওলাইকুম সালাম। কাকে চাই?’ 

‘কাউকে চাইনা। বুলবুলি আছেন?’ 

‘ওতো বাড়িতে নেই। তুমি কে?’ 

‘আমি একজন ছড়াকার। চমৎকার ছড়া লিখি!’ 

‘রৌদ্র?’ 

‘হু। ছড়াকার রৌদ্র অধিকারী। আপনি ঠিক চিনেছেন।’ 

‘আমি চিনিনা। মামনি চিনে। ও বলে গেছে-তুমি আসলে যেন যেতে না দিই। এসো ভিতরে এসো।’ 

‘বুলবুলি জানে আমি আসবো?’ 

‘জানবেনা কেন! তুমি আসবে জন্যেইতো নিজে বাজারে গিয়ে পছন্দমত নাস্তা-পাস্তা নিয়ে এলো। তার মধ্যে ইন্টারেক্টিং একটা আইটেম হচ্ছে-“লাভ বিস্কুট”। দেখেছ কখনো?’ 

‘না, দেখিনি।’ 

‘আমিও দেখিনি!’

সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো একটা ঘরে বসে আছি। সিঙ্গেল বক্স খাট। খাটে সাজিয়ে রাখা বেশ কয়েকটা পুতুল। এক সেট বেতের সোফা। টেবিলের উপর সুন্দর, ছোট্ট মাটির টবে বাঁশ পাতার মতো ছয় পাতা বিশিষ্ট একটা বৃক্ষ। বৃক্ষের নাম কি জানিনা। নাম দিলাম-“অজানা বৃক্ষ”। দেয়ালে সাঁটানো বেশ কটা নানান পোজের ছবি। বুলবুলির ছবি। ছবি বলে দিচ্ছে এই ঘরটা বুলবুলির। ঘরের ভিতরে অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ। কোত্থেকে আসছে কে জানে! আমি এই ঘরটার নাম দিলাম- “বুলবুলি কক্ষ”।

এর মধ্যে বুলবুলি এসে গেছে। মেয়েটাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ঘেমেটেমে একাকার অবস্থা। শ্যামা কিংবা উজ্জ্বল শ্যামা মেয়েদের এই একটা সমস্যা। বেশিক্ষণ গরমে থাকলে তেলতেলে অবস্থা হয়ে কালো হয়ে যায়।

আমি বুলবুলির সামনে বসে আছি। ফ্রেস হওয়ার পর মেয়েটাকে অসম্ভব রুপবতী দেখাচ্ছে। ভেজা ভেজা চুলে মেয়েদের রুপ এম্নিতেই বদলে যায়। এই মেয়ের রুপ বদলে ডাবল হয়ে গেছে! আমি ডাবল রুপের বুলবুলির দিকে তাকিয়ে আছি। কতক্ষণ কে জানে!

‘কি দেখছেন?’

‘আপনাকে। ভীষণ রুপবতী দেখাচ্ছে। নায়িকা শাবনুরের মত!’

‘আমি কিন্তু নায়িকা শাবনুর নই, বুলবুলি।’

‘আপনার চোখের নিচটা কালো হয়ে গেছে। কাজল ব্যাবহার করেন? দরকার নেই – আপনার চোখ এম্নিতেই সুন্দর। হরিনী চোখ!’

আমি বিস্মিত হলাম। সামসামনি রুপবতী বললে মেয়েদের মাঝে খুশিতে গদগদ ভাব চলে আসে। বুলবুলির ক্ষেত্রে তেমন কিছু হলোনা। উল্টো তার চোখে মুখে কঠিন ভাব চলে এসেছে। কেন, সেটা বুঝতে পারছিনা।

বুলবুলি বললো-‘আমি চোখে কাজল দেইনা। চোখের নিচে কালো দাগ পরেছে-সেটা অন্য কারনে। কারনটা পরে বলি। তার আগে বলুন – আমি যে আপনার উপর ভীষণ রেগে যাচ্ছি সেটা কি আপনি বুঝতে পারছেন।’

‘পারছি।’

‘কেন রেগে যাচ্ছি জানেন?’

‘জানিনা।’

‘আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন না কেন? হুম?’

আমি বুলবুলির দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম-‘বুলবুলি, তুমি কি আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়াবে? বরফ শীতল ঠাণ্ডা পানি।’

আমি বরফ শীতল ঠাণ্ডা পানি পান করলাম। বুলবুলি বললো-‘রৌদ্র, তুমি কি কষ্ট পেয়েছ?’ ওর চোখে পানি।

‘না, কষ্ট পাইনি। বুলবুলি, আমি কি তোমার নামটা কেটে কুটে ছোট করে দিতে পারি?’

বুলবুলি চোখ মুছতে মুছতে বললো-‘অবশ্যই পারো। নামের মানুষটাকে আগেই কেটে ফেলেছ। নামটা কাটলে তেমন কিছু হবেনা। তুমি বসো, আমি সিজার আর একটা চাকু নিয়ে আসি! ধারালো চাকু!’

‘কিছু লাগবেনা।’

‘লাগবে! সিজার দিয়ে আমার নাম কাটবে আর, চাকু দিয়ে আমাকে!’

‘তোমার নাম কেটে ফেলেছি-বুবলি। বুলবুলি থেকে বুবলি। ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে।’

বুবলি কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। তার কান্নার কারন কি? বুঝতে পারছিনা। আমি বললাম-‘বুবলি, আনোয়ারা খালা বলেছিলেন, তুমি আমার জন্য বিশেষ নাস্তার আয়োজন করেছো। নিয়ে এসো-খেয়ে চলে যাই।’

‘আমার আম্মুর নাম-আনোয়ারা। তুমি জানলে কি করে?’

‘জানতাম না। এখন জানলাম।’

‘মানে।’

‘উনাকে দেখতে অবিকল অভিনেত্রী আনোয়ারার মতো!’

বুবলি অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে কিছু কথা লেখা আছে-আমি পড়তে পারছিনা।

টেবিলে নাস্তা সাজানো। চাঁর পাঁচটা আইটেম। আমি শুরু করলাম হৃদপিন্ড আকৃতির বিস্কিট দিয়ে। লাভ বিস্কিট। ভালবাসার নাস্তা ভালবাসা দিয়ে শুরু। বুবলি লাভ বিস্কিট হাতে নিয়ে বললো-‘ সেদিন ফোনে একটা কথা বলতে চেয়েলিলাম, বলতে পারিনি!’

‘এখন বলতে পারো।’

‘আমি ঘুমাতে পরিনা।’

‘ও।’

‘আমার কিছু ভাল লাগেনা!’

‘ও।’

‘নিজেকে পাগলি পাগলি মনে হয়!’

‘ও।’

‘রৌদ্র, কেন আমি ঘুমাতে পারিনা। কেন কিছু ভাল লাগেনা। নিজেকে পাগলি পাগলি মনে হয় কেন-তুমি জানতে চাওনা?’

‘চাই।’

‘আমি একজনের প্রেমে পরে গেছি। ভীষণ ভালবাসি তাকে। তুমি শুনতে চাওনা-কে সে?’

‘শুনতে চাই। কে সে?’

‘তুমি। রৌদ্র। ছড়াকার রৌদ্র অধিকারী।’

বুবলি আমার হাত ধরে বসে আছে। ওর কান্না এখনো বন্ধ হয়নি। কিছু মানুষ আছে-দীর্ঘ দিনের জমানো কষ্ট চেপে রেখে একদিনেই চোখের পানিতে শেষ করতে চায়। বুবলি তাদেরই একজন। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে- জীবনের কষ্ট একদিনের কান্নায় শেষ হয়না।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। বুবলি আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে। আমি বললাম -‘আসি।’

‘কিছু বলবা না।’

‘বলবো।’

‘কবে?’

‘বুবলি, যে কথাটা তুমি শুনতে চাচ্ছো-সেটা আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বলতে পারবোনা। কোনদিনও না। কিন্তু, কথাটা শোনার জন্য তোমাকে সময় নিতে হবে। সময় মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়।’

(দুই)

চাঁর বছর অনেক সময়। অনেক কিছুই বদলে গেছে। বুবলিও বদলে গেছে। চটপটে বুবলি আর চটপটে নেই। শান্ত হয়ে গেছে। প্রায়ই আমাদের কথা হয়। দেখাও হয়। বিশেষ বিশেষ দিনে আমরা চিকলির বিলে যাই বাদাম খেতে। বুবলির মতে- চিকলির বিলে বসে বাদাম খাওয়া আর তাজমহলে বসে বাতাস খাওয়া নাকি একই কথা!

আজ বুবলিকে নিয়ে ভাবার কারন হচ্ছে- গতকাল ওর ফোন এসেছিলো। ফোনে যা কথা হয়েছিলো তা হলোঃ-

‘হ্যালো রৌদ্র, কেমন আছো?’

‘এইতো। তুমি?’

‘ঐতো! কোথায়?’

‘রুমে।’

‘তারপর বলো -তোমার ছড়ার বইয়ের কি খবর?’

‘পাণ্ডুলিপি রেডি।’

‘গুড। কবে বলছো তোমার কথাটা?’

‘কাল।’

‘কোথায়?’

‘চিকলির বিল।’

‘কখন?’

‘বিকেল পাঁচটায়।’

‘আমি অপেক্ষা করবো। ঠিক বিকেল পাঁচটায়। ছড়ার বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে এসো। ওটা আমার চাই। ওকে?’

‘ওকে।’

‘গুড বয়। ইউ আর এ রিয়ালি গুড বয়।’

চিকলির বিলে আমরা তিনজন দাড়িয়ে আছি। আমি বুবলি আর মাসুদ। মাসুদ হচ্ছে বুবলির ফ্রেড। সম্ভবত বেস্ট ফ্রেড। লম্বা ফর্সা-সুদর্শন আর স্মার্ট এই ছেলেটাকে একবার দেখেই যেকোন মেয়েরই হৃদপিন্ড ফুটো হয়ে যাওয়ার কথা। ছেলে মানুষ এতো সুন্দর হয় কিভাবে!

বুবলি বললো-‘রৌদ্র, তুমি আজ কি বলবে আমি জানি। তিন শব্দের ছোট্ট একটা কথা। ধৈর্য নিয়ে শুনতে হবে। মাসুদ আমাকে একটা জরুরি কথা বলতে চায়। যেহেতু জরুরি কথা সেহেতু আগে ওর কথাটা শোনাও জরুরি। তুমিও শুনতে পারো। বুবলি মাসুদের দিকে তাকিয়ে বললো-মাসুদ, তোমার জরুরি কথাটা বলে ফেল। চিৎকার করে বলো।’

মাসুদ চিৎকার করে তার জরুরি কথাটা বুবলিকে বলে দিল। তিন শব্দের অতি মূল্যবান একটা কথায় প্রকম্পিত হলো বিলের চারদিক। সম্ভবত সারা পৃথিবীটাও।

কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া আকাশ থেকে বৃষ্টি নেমে এলো। আমি ছড়ার পান্ডুলিপিটা চিকলির বিলে ছুড়ে দিয়ে হাটতে শুরু করলাম তিন শব্দে বাঁধা পরা দুজন মানুষকে পিছনে ফেলে।

মোবাইল বেজে উঠলো। বুবলির ফোন। আমি ফোন বন্ধ করে দিলাম। বুবলির সাথে আর কথা হবেনা। কোনদিনই না।

ঠোঁটের কোণায় নোনতা স্বাদ অনুভব করলাম। বৃষ্টির পানি নোনতা হয়না। নোনতা হয় মানুষের চোখের পানি। আমি সম্ভবত কাঁদছি।

RELATED ARTICLES

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

জনপ্রিয়

Recent Comments

মোকাদ্দেস-এ-রাব্বী on আমার শুধু ঘুমিয়ে পড়া বাকি
মোকাদ্দেস-এ-রাব্বী on আকাশের কল্পনা
Sazzad Mohammad on বুবলি 
মোকাদ্দেস-এ-রাব্বী on বুবলি