লিখেছেন- শাকিব হুসাইন
ঈশান কোণে মেঘেদের দাপাদাপি চলছে। গুড়গুড় গুড়ড়ড়ুম। দুড়দুড় দুড়ড়ড়ুম। একটু পরেই কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হবে। হাসুনি পাড়ার ছেলেরা ভীষণ খুশি। সবার মনে দারুণ উত্তেজনা। ঝড় থামলেই ছুটবে করিমদের মিষ্টি আমবাগানে।
ঝড় শুরু হয়েছে ভীষণ ঝড়! সে কী! দুড়ুমদুড়ুম দুড়ড়ড়ড়ড়ড়ুম! শো শো বাতাস আর বাতাস ঘিরে ধরেছে পাড়াটাকে!
ঝড় থামল মিনিট বিশেক পড়। ঝড় থামার সাথে সাথে জিতুরা করিমদের আমবাগানে দে ছুট।
পাড়ার ছেলেদের সর্দার জিতু। ওর হুকুমে সবাই চলে। ওরা সারাদিন দস্যিপনা করে বেড়ায়। কোন গাছে আম ধরেছে। কোন গাছে জাম ধরেছে। কোন গাছে লিচু ধরেছে। তন্নতন্ন করে খোঁজে। এগুলোই ওদের নিত্যদিনের কাজ।
একদিন ভরদুপুরে জিতুরা সবাই করিমদের আমবাগানে ঢুকে পড়ল। মিষ্টি মিষ্টি আম দেখে আর লোভ সামলাতে পারল না। সবাই উঠে পড়ল গাছে। ব্যাগ ভর্তি আম পাড়ল। কিন্তু সেই সময়ই বিপত্তিটা ঘটল। কোত্থেকে যেন করিমদের আমবাগানের ইয়া বড় গোঁফওয়ালা পাহারাদারটা চলে এলো। সবাই ধরপর ধরপর করে গাছ থেকে নেমে পালাল। শুধু নামতে পারল না জিতু আর দিনু। দু’জনে গাছের একেবারে মগডালে চড়েছিল বলে আর নামতেই পারেনি। পাহারাদারকে দেখে দু’জনে পাতার ভিতরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। পাহারাদারের চোখ গাছের মগডালে পৌঁছাতেই পারেনি। পাহারাদার চলে গেলে তারা গাছ থেকে নামার প্রস্তুতি নেয়৷ ঠিক তখনই দেখতে পেল পাতার ফাঁকে একটা ঘুঘু পাখির বাসা। ঘুঘু পাখির বাসা দেখে দু’জনে খুশিতে আটখানা। কাছে গিয়ে দেখল দুটো নাদুসনুদুস ছানা শুয়ে আছে। ঘুঘু পাখির বাসাটা নিয়ে নেমে পড়ল। গাছ থেকে নেমেই ঘুঘু পাখির বাসাটা নিয়েই দিল একছুট। একছুটে চলে এলো বুড়ো বটগাছটার নিচে।
জিতু বলল— যাক, আমের সাথে দুটো ঘুঘু ছানা পাওয়া গেল। আজ তো আমাদের অনেক খুশির দিন রে। চল এগুলো দিয়ে পিকনিক করি একটা।
হঠাৎ দিনুর মনটা কেমন যে হু হু করে উঠল। বলল— না রে জিতু। ছানাগুলোকে দেখে কী তোর এতোটুকুও মায়াদয়া হচ্ছে না? কী সুন্দর ছোট্ট দুটো ছানা! বরং চল বাসাটা গাছেই রেখে আসি।
—আরে, এসব কী বলিস?
—আমি ঠিকই বলছি।
— এই যে বাসাটা ভেঙে দিলাম আর ছানা দুটোকে নিয়ে আমি চললাম।
এই বলে জিতু ঘুঘু ছানা দুটোকে নিয়ে চলে গেল। ছানা দুটোকে না খেয়ে খাঁচায় বন্দী করে রাখল।
কয়েকদিন পর আবারও মেঘেদের দাপাদাপি শুর হয়েছে। কখন জানি হঠাৎ করে কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে যায়! কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো ঝড়। হু হু করে বাতাস বইতে থাকল। পাশের জয়দের টিনের চাল উড়ে এলো জিতুদের বাড়িতে। দিনুদের খড়ের গাদাটা নিমেষেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। একপর্যায়ে জিতুদের ঘরের চালও ঝড়ে উড়ে গেল। ঝড় থেমে গেলে তাদের বাড়িতে কান্নার রোল পরে গেল।
জিতুর ঘুঘু ছানারগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। খড়িঘরে লুকিয়ে রেখেছিল। জিতু দেখল ছানাদুটো ঠাণ্ডায় জড়সড় হয়ে আছে। হঠাৎ জিতুর কী থেকে কী হয়ে গেল! মনে মনে ভাবল, আমাদের বাসা না থাকার কারণে আমাদের কত কষ্টই না হচ্ছে। নিশ্চয়ই পাখিদেরও বাসা না থাকলে ভীষণ কষ্ট হয়। জিতু এবার তার ভুল বুঝতে পারে। দেরি না করে সাথে সাথে চলে গেল দিনুদের বাড়ি। তারপর দু’জনে চলল করিমদের আমবাগানের বড় গাছটায়। গাছে উঠে দেখল একটা পাখি এডাল থেকে ওডালে ঘোরাঘুরি করছে আর করুণ সুরে ডাকছে। বেশকিছু দিন ধরেই পাখিটা সন্তানের জন্য ছোটাছুটি করছে গাছটায়। জিতু বুঝতে পারে এটা সন্তান আর ঘরবাড়ি হারানো ডাক। জিতু একটা লাউয়ের খোল এনেছিল ঘুঘু পাখির জন্য। আজ থেকে ঘুঘু মা ও তার ছানারা এই লাউয়ের খোলেই থাকবে। আর কোনদিন তাদের বাসা ভাঙবে না। লাউয়ের খোলটা গাছে বেঁধে দিয়ে ছানা দুটোকে রেখে দিল। জিতু গাছ থেকে নামতেই মা ঘুঘুটা ছুটে গেল ছানাদের কাছে। মন ভরে আদর করতে লাগল ছানাদের। এসব দেখে জিতু আর দিনু মুচকি মুচকি হাসে। দুজনে বাড়ির পথ ধরল। হঠাৎ মাথার উপরে দেখল মা ঘুঘ পাখিটা উড়াউড়ি করছে। জিতু বুঝতে পারে পাখিটা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।