পল্লব শাহরিয়ার
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সাহিত্যে যতটা বিদ্রোহী, ততটাই বিদ্রূপী। তাঁর লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপমূলক গদ্য। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’, ‘ব্যথার দান’, ‘বঙ্গের প্রেম’ ইত্যাদি রচনায় তিনি শব্দের সূক্ষ্ম বর্শা দিয়ে আঘাত করেছেন সমাজ, ধর্ম এবং রাজনীতির অন্ধকার প্রাচীরে। তাঁর লেখার ভাষা, কৌশল ও রূপক ব্যবহার আধুনিক রাজনৈতিক কার্টুনের মতোই স্পষ্ট, ধারালো এবং চিন্তাক্রান্তিক।
‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’ আসলে একটি ব্যঙ্গাত্মক ‘আত্মপক্ষ সমর্থন’। এখানে নজরুল নিজেকে অভিযুক্ত হিসেবে দাঁড় করিয়ে যে যুক্তি দেন, তা শুধু ব্রিটিশ সরকারের নয়, গোটা উপনিবেশিক শাসন কাঠামোর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ পংক্তি—“আমার অপরাধ এই যে, আমি মানুষকে জাগাতে চেয়েছি”—হাস্যরসের মোড়কে এক ধ্বংসাত্মক সত্যের উদ্ঘাটন করে।
আধুনিক রাজনৈতিক কার্টুন একটি দৃশ্য বা চরিত্রের মাধ্যমে গভীর রাজনৈতিক সংকেত দেয়। নজরুল ঠিক একই কাজ করেছেন শব্দ ও রূপকের মাধ্যমে। ‘ব্যথার দান’ রচনায় ব্যথাকে ‘দান’ হিসেবে উপস্থাপন করে তিনি উপহাস করেছেন সেই সমাজকে, যেখানে মানুষের যন্ত্রণা একরকম দায়সারা দয়ালুতায় ঢাকা পড়ে যায়।
এইসব রচনায় নজরুলের ভাষা নাটকীয়, বিদ্রুপাত্মক এবং অতিরঞ্জিত—যেমনটি দেখা যায় মুদ্রিত কার্টুনে। একটি রসাত্মক বাক্যে বা চরিত্রে নজরুল এমন একটি পরিস্থিতি আঁকেন, যা কেবল সেই সময় নয়, আজও প্রাসঙ্গিক।
নজরুলের ব্যঙ্গ একদিকে যেমন পাঠককে হাসায়, অন্যদিকে তেমনি অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। পাঠক মর্মে অনুভব করে—হাসির আড়ালে রয়েছে গভীর ব্যথা, রয়েছে প্রতিবাদ, রয়েছে রাজনৈতিক বোবা চিৎকার।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, নজরুল ছিলেন একজন সাহিত্যিক কার্টুনিস্ট, যিনি কলম দিয়ে এঁকেছেন ভাষার ব্যঙ্গচিত্র। তাঁর ব্যঙ্গাত্মক গদ্য শুধুই রসবোধ নয়—এটা ছিল এক সাহসী সাহিত্যিক প্রতিবাদ, যা আজকের রাজনৈতিক কার্টুনের মতোই সমকালকে খণ্ডবিখণ্ড করে দেখাতে চায়।